ট্রায়াঙ্গেল (Triangle 2009) : এক রোমাঞ্চকর মনস্তাত্ত্বিক ছবি
এমন কোন সিনেমা দেখেছেন? মনে হয় প্রথমে এটা এডভেঞ্চার ফিল্ম, একটু পর হরর বা থ্রিলার, তারপর সায়েন্স ফিকশন। এবং সব শেষে গভীর জীবনদর্শন ! ট্রায়াঙ্গেল সম্বন্ধে দু’রকম মত পাবেন – অসাধারণ, আর খুবই বাজে। প্রতিবেদকের চ্যালেঞ্জ আপনি “মোটামুটি” বলতেই পারবেন না। যদি ভাল লেগে যায় তাহলে আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে। গোগ্রাসে গিলতে হবে এই ছবির প্রতিটি মুহুর্ত। অসীম সময় অবধি আপনি ভাবতে থাকবেন নির্দেশক ঠিক কি কি বলতে চেয়েছেন।
এক ঘন্টা আটত্রিশ মিনিটের এই সিনেমার গল্পটা অন্যরকম। এমনই, যে স্পয়লারের এক অংশ প্রথমে না বললে কিছুই বলা যায় না। তবে এ এমন গল্প, যে স্পয়লার বললে আপনার সুবিধা বৈ অসুবিধা নেই।
স্পয়লার
এমন যদি কোনদিন হয় – আপনি দরজায় কলিং বেল শুনে গিয়ে দেখলেন কেউ নেই, তারপর ঘরে ঢুকেই দেখলেন আপনি নিজেই ঘরে ঢুকে গেছেন ওই ফাঁকে পেছনের দরজা দিয়ে? এমন হয়েছে কারণ, আপনার কিছু ত্রুটি শুধরাতে আপনি ভবিষ্যৎ থেকে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন এক ঘোরতর এবং অবশ্যম্ভাবী বিপদের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে আজ। তাই ভবিষ্যৎ থেকে আপনি ফিরে এসেছেন। বিপদের ঠিক কয়েকঘন্টা আগে। সেই আশু দুর্যোগ কি এড়ানো যাবে?
মুখবন্ধ
দু হাজার নয় সালে, ট্রায়াঙ্গেল রিলিজ হওয়ার কিছুদিন আগে মুক্তি পেয়েছিল ট্যারেন্টিনোর “ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস”। কিছুদিন পর ক্যামেরনের “আভাটার”। এর মাঝে অখ্যাত নির্দেশকের সাধারণ অভিনেতাদের নিয়ে বানানো সিনেমাটি কখন এল, কখন গেল কেউ খোঁজ রাখেনি। সিনেমাটি এমনও নয় চট করে দেখতে ঢুকে গেলাম আর মন ভরে গেল। বরং বেশ কঠিন। হয়ত তাই যা বাজেট নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তার দশভাগের একভাগ টাকাই তুলতে পারল।
এত সুপারফ্লপ সিনেমা নিয়ে কথা বলছি। কারণ? “বাইসাইকেল থিবস” দেখতে বলার জন্য আপনাকে সারা দুনিয়াই তো পড়ে আছে।
রেটিং
(১) রটন টম্যাটোস ৮০% (২) আই এম ডি বি ৬.৯ (৩) প্রতিবেদক ৮৫/১০০
কাহিনীর প্রথম ভাগ
সিঙ্গল মাদার জেসের তার মানসিক প্রতিবন্ধী পুত্র টমিকে নিয়ে তিতিবিরক্ত। একদিন একটু একঘেয়েমি কাটাতে এক ইয়াট রাইডে যায়। সঙ্গী হয় বন্ধু গ্রেগ, গ্রেগের বান্ধবী স্যালি, স্যালির স্বামী ডাউনি, স্যালির বান্ধবী হেদার এবং গ্রেগের সাকরেদ ভিক্টর। ছুটির আমেজ মাখা এক শনিবারে, সোনালী রোদ মেখে শুরু হয় তাদের অভিযান! মাঝ সমুদ্রে হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে থমকে যায় ওদের ইয়াট। ওরা দেখে ধেয়ে আসছে ঘন কালো মেঘ। ওয়্যারলেস মারফত প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে গ্রেগ এবং ব্যর্থ হয়। সেই সময় ওরা বেতার বার্তায় পায় এক বিপণ্ন মহিলার আর্ত চীৎকার।
এই অবধি গল্পে বেশ এডভেঞ্চার বা ডিজাস্টার মুভির একটা আবেশ থাকে।
যাত্রাপথে
ওদের বিপদ বাড়িয়ে শুরু হয় তীব্র ঝড় আর বৃষ্টি! জেস আর গ্রেগদের নৌকা উল্টে যায়। হেদার নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, কোনক্রমে প্রাণ বাঁচায় বাকিরা! খাবি খেতে খেতে দেখে ঝোড়ো হওয়ায় ভেসে আসছে এক বিরাট জাহাজ, নাম Aeolus। ওদের একজনের মনে হয় ডেকে একজন দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে।
Aeolusকে মনে আছে? উনি ছিলেন বায়ুর দেবতা ও একটি ভাসমান দ্বীপের মালিক। ইচ্ছা অনুযায়ী বাতাসের গতি ও দিক পরিবর্তন করতেন। আরেকটি পরিচয় গ্রিক পুরানে বিখ্যাত সিসিফাসের পিতা। সেই সিসিফাস, যিনি মৃত্যুকে দু’বার ধোঁকা দিয়ে সারাজীবন শাস্তি পান একই কাজ করে যাওয়ার।
যাই হোক, জাহাজে উঠে তো পড়ে ওই পাঁচ জন, কিন্ত লোকজন কই? ডেক, করিডোর, চেম্বার, বলরুম, সব খুঁজেও কেউ নেই! এরপরই শুরু হয় এক ভয়ঙ্কর খেলা। এক লুকোনো আততায়ীর আক্রমণে জীবন সংকটে পড়ে পাঁচজন!
এই অবধি বেশ একটা হরর বা থ্রিলার সিনেমা বলে মনে হয়।
শেষের একটু আগে
একে একে সঙ্গীরা মারা যেতে থাকেন একটু পরেই সাক্ষাৎ মৃত্যুর সম্মুখীন হয় জেস। ও বুঝতে পারে ওর মৃত্যুও সময়ের অপেক্ষা। কিন্ত ওকে তো ফিরে যেতেই হবে, বুঝতে পারে জাহাজে ওঠা ভুল হয়েছে। এমন সময় দূর থেকে দেখে ভেসে আসছে একটি উল্টানো ইয়াট। তাতে সাহায্য চাইছে ওরা নিজেরাই। অর্থাৎ জেস কোনভাবে ভবিষ্যৎ সময়ে চলে এসেছে। অতীতকে সামান্য বদলে দিলেই ও ফিরে পাবে ছেলেকে। তাই প্রাণপণ চেষ্টা করে সবাইকে বাঁচানোর।
এই অবধি এসে মনে হয় এটা সায়েন্স ফিকশন।
শেষ অংক
অনেক চেষ্টা করেও জেস বারবার মৃত্যুর সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদিকে ছেলে মায়ের অপেক্ষায়, তাই বারবার ও মৃত্যুকে অস্বীকার করে। কিন্ত ভবিষ্যৎ সময় থেকে ফিরে আসতে থাকে বারবার সেই নৌকাডুবির মুহূর্তে।
একসময় জেস বুঝতে পারে পুরো সমস্যায় ওর নিজের কোন কিছু ভুল আছে। নিজের অতীতের কোন ভুল শোধরানো দরকার। কোন
বাকিটা জানার জন্য সিনেমাটি দেখলে ভাল হয়।
প্রতিবেদকের ভাবনা
শেষ পর্বে এসে সিনেমাটি বেশ কিছু জীবন দর্শন তুলে আনে। সিনেমাটি বহুস্তরীয়।
সিসিফাস https://roar.media/bangla/main/myth/sisyphus-who-wanted-to-cheat-deathযেমন মৃত্যুকে ধোঁকা দিয়ে অমর হন, কিন্ত ওঁকে সারাজীবন একটি বিশাল পাথর পাহাড়ের মাথায় তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সে পাথর বারবার গড়িয়ে নীচে চলে আসে।
আমাদের জীবন চলে নিজের ছন্দে, তার তালে পা মেলানো আমাদের দায়িত্ব। জীবন অপেক্ষা করে না। বেশিরভাগ বড় ভুলও শোধরানোর সুযোগ হয় না। উল্টে আমরা বারবার ভুলের পুনরাবৃত্তি করি। অনুশোচনা আবার অনেক কিছু ঠিক করে নিতে বলে, কিন্ত ফিরে গেলেও যে অন্যথা হবেই তা বলা যায় না। বরং সামনে আবার দেওয়াল দেখা যায়। জেসও বারবার তার হাতঘড়িতে একই সময় দেখতে পায়। ক্ষয়ক্ষতি মেনে, চরৈবেতির মন্ত্রকে সামনে রেখে চলতে শিখলে পথটা হয়ত মসৃন হয় আমাদের।
ট্রায়াঙ্গেলের চিত্রনাট্য নির্মেদ। একটাও অপ্রয়োজনীয় দৃশ্য নেই, সবকটি সুদক্ষভাবে চলচ্চিত্রায়িত। ক্যামেরার কাজ ও ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকও ভাল।
অভিনয়ে জেসের ভূমিকায় মেলিসা জর্জ অসাধারণ অভিনয় করেছেন। গ্রেগের চরিত্রে মাইকেল ডোরম্যানকেও ভাল লাগে!
গ্রেগ তার বন্ধুদের যে নৌকায় চড়িয়ে সমুদ্রবিহার করতে বেরিয়েছিল তার নাম ছিল Triangle। সেখান থেকেই এই ফিল্মের নাম ট্র্যাঙ্গেল একথা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে অন্য কিছুও হতে পারে। যার অন্যতম হতে পারে মানুষের জীবনের সঙ্গে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সংযোগ অর্থাৎ ট্রায়াঙ্গেল ।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সেইসব সিনেমাকে এগিয়ে রাখি যেগুলি আমি একাধিকবার দেখতে চাইব। ট্রায়াঙ্গেল সহজপাচ্য নয়। দুবার দেখে ওঠা মুশকিল, তাই কিছু নম্বর বাদ গেল।
তবে এ সিনেমা সেই সিনেমাগুলির মধ্যে পড়ে যা একবার না দেখলেও নয়।
Leave a Reply